ঢাকা , সোমবার, ০২ জুন ২০২৫ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​হানিফ ফ্লাইওভার টোলের ১২০০ কোটি টাকা ওরিয়ন গ্রুপের পেটে!

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৯-০৫-২০২৫ ০৮:৩৬:২৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৯-০৫-২০২৫ ০৮:৩৬:২৯ অপরাহ্ন
​হানিফ ফ্লাইওভার টোলের ১২০০ কোটি টাকা ওরিয়ন গ্রুপের পেটে! ​হানিফ ফ্লাইওভার টোলের ১২০০ কোটি টাকা ওরিয়ন গ্রুপের পেটে!


প্রতিনিধির নাম


✓✓ড্রাইভারকে ব্যাবসায়িক পার্টনার বানিয়ে ঋণ নেয় ওরিয়ন৷ ✓✓গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও নেই!

✓✓জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ, সেই ঋণের ৪ হাজার কোটি টাকা পাচার 
✓✓বিদ্যুৎকেন্দ্রে নজিরবিহীন
✓✓এখনো হাতে হাতে টোল আদায়
✓✓রসিদ দিয়ে টোল নেওয়ায় হিসাব থাকে না সফটওয়্যারে
✓✓১২ বছর ধরে চলছে লুট
✓✓টোলের ৪০ শতাংশ টাকা জমা দেওয়া হলেও ৬০ শতাংশ গোপনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে

অনলাইন ডেস্ক: সাবেক সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতাদের ব্যাবসায়িক পার্টনার বানিয়ে গত ১৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার ও হাতিয়ে নিয়েছে ওরিয়ন গ্রুপ কোনোরকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ এরকম নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে নিজের ‘ডাইভাবকেও বানিয়েছে পার্টনার৷ এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানে নির্মিত হানিফ ফ্লাইওভার নিমবাড়ী ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে। এছাড়াও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে আলোচিত দুর্নীতিবাজ এনবিআর এর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও দুর্নীতি অনিয়মের বহু অভিযোগ রয়েছে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

সড়ক ১ জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলে ৮-১০ হাজার ৷ সে হিসাবে টোল আদায় হওয়ার কথা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা৷ আর ওরিয়ন হিসাব দিচ্ছে বছরে মাত্র ১৪০-১৭৮ কোটি টাকার ।

গত ৫ আগস্টের পর দায়িত্ব নেওয়া তত্ত্বাবধায়ক চৌধুরী খালেদ মাসুদ ও একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নেই বললেই চলে৷ তবে কিছু সময় ওরিয়ন গ্রুপ হয়তো কৌশল নিয়ে কাজ করেছে, এ জন্য হয়তো অনেকেই বিষয়টি অন্যভাবে দেখছেন৷

সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যে ফ্লাইওভার তা নির্মিত হয়েছে, এই ওরিয়ন গ্রুপের তত্ত্বাবধানেই৷ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ওবায়দুল করিম ফ্লাইওভার থেকে আদায়কৃত টোলের মাত্র ৪০ শতাংশের হিসাবে দেখান৷ বাকি ৬০ শতাংশ টোলের টাকা গোপনে সরিয়ে নিচ্ছেন৷ গত ১২ বছর ধরেই চলছে এমন ঘটনা৷ ফ্লাইওভার সরেজমিন ঘুরেও এমন চিত্র দেখা গেছে৷ নির্দিষ্ট টোল প্লাজা বাদ দিয়েই ফ্লাইওভারের বিভিন্ন পয়েন্টে চালকদের হাতে রসিদ ধরিয়ে টোল আদায় করছেন ওরিয়নের পোশাক পরিহিত কিছু ব্যক্তি। এভাবে টাকা নেওয়ায় হিসাব থাকছে না কম্পিউটারের সফটওয়্যারে৷

জানা গেছে, অনুমোদনের শুরুতে ৩ বছর মেয়াদে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও দফায় দফায় এ মেয়াদ বাড়িয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে শত শত কোটি টাকা৷ একই কেন্দ্র সরকারের কাছে একাধিকবার বিক্রি করা হয়। এসব কেন্দ্রের মোট বিনিয়োগের ২৫-৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারীরা দেয়, বাকিটা ব্যাংকঋণের মাধ্যমে মেটানো হয়৷ এভাবেই ১৫ বছর ধরে লুটপাট চালিয়েছেন ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও এসব অপকর্মের মূল হোতা ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধারের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না দেখে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন৷ সূত্রমতে, দেশে গত সাড়ে ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে মহালুটপাটের ঘটনায় ওরিয়ন গ্রুপের আগ্রাসন ছিল ভয়াবহ। এসব অপকর্মে সহযোগী হিসেবে ওবায়দুল করিম বেছে নিয়েছেন বিগত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের৷ এর মধ্যে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যাবসায়িক পার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছেন তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী মির্জা আজমকে৷ তাকে ৪০ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যাবসায়িক পার্টনার করা হয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। তাকে ৩০ শতাংশ ছেড়ে দিয়ে ৭০ শতাংশ নিজে রেখেছেন ওবায়দুল করিম৷

ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের ৪ শতাংশ শেয়ার নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে এবং ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ সাবেক মন্ত্রী মির্জা আজমকে দিয়ে ব্যাবসায়িক পার্টনার বানানো হয়েছে৷ এ ছাড়া ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার দিয়ে মির্জা আজমকে পার্টনার বানিয়েছেন ওবায়দুল করিম।

জানা গেছে, চুক্তির শর্ত অনুসারে ৩ বছরের মেয়াদে প্রকল্পের দায়িত্ব পেলেও পরবর্তী সময়ে সেই মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে নিয়েছেন৷ মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ওবায়দুল করিম হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অস্তিত্বহীন কোম্পানিও রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছু দিন আগে অন্তত সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন ওবায়দুল করিম৷ এখানেই শেষ নয়, বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে ওরিয়নের ৭টি কোম্পানি দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের ৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ১৫ বছরে কোনোরকম দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই কোনো কাজে আসেনি৷ এর মধ্যে বেসরকারিভাবে উৎপাদনসংক্রান্ত ওরিয়ন গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে রাষ্ট্রের কাছ থেকে ৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা নিয়েছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেড, ডাচ্- বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা লিমিটেড, ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা ইউনিট-২ লিমিটেড, ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেড এবং ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগা ও লিমিটেড। এর মধ্যে ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা ইউনিট- ২-এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিধি ভঙ্গ করে শুধু ওরিয়নের ক্ষেত্রে (বিদ্যুৎ খাত) সমস্যাজর্জরিত জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷ অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা-২ লিমিটেডের (ওপিডিএল-২) নামে কক্সবাজারের মহেশখালীতে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এ ঋণ অনুমোদন করা হয়৷ নবায়নযোগ্য সোলার পাওয়ার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি এনারগন টেকনোলজি অ্যান্ড ফার্স্ট জেন এনার্জি এবং চায়না সানার্জি কোম্পানির নামে ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা ঋণ নেন ওবায়দুল করিম। এ ঋণের খেলাপি টাকার পরিমাণ অন্তত ৫০০ কোটি৷ এ কোম্পানিতে ওবায়দুল করিমের পার্টনার তার ড্রাইভার খালেদ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ।

ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা ইউনিট-২-এর নামে ঋণ নেওয়া হয় ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। এটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি৷ এই প্রতিষ্ঠানের খেলাপিঋণের পরিমাণও ৫০০ কোটি টাকা৷ এ ছাড়া ১০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের নামে ৮১১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়৷ এখানেও খেলাপির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা।

ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেডের নামে ২৩৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়৷ ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের নামে ঋণ নেওয়া হয় ৬২৫ কোটি টাকা৷ ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের নামে ঋণ ১০২ কোটি টাকা এবং ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ঋণ নেওয়া হয় ৩৪০ কোটি টাকা৷ এভাবে বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে ওবায়দুল করিম হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানার জন্য গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে ৫ আগস্টের পর দায়িত্ব নেওয়া ওরিয়ন গ্রুপের তত্ত্বাবধায়ক চৌধুরী খালেদ মাসুদের সেলফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি ষাড়া দেননি

নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ